ট্রান্সফরমারের সুরক্ষা ব্যবস্থা (Transformer Protection System):
বৈদ্যুতিক মেশিনগুলোর মধ্যে ট্রান্সফরমার একটি সহজ ও সরল গঠনের মেশিন। ট্রান্সফরমার একটি স্থির বৈদ্যুতিক মেশিন যার কোরটি ওয়াইন্ডিংসহ সচরাচর একটি স্টিল ট্যাংকের তেলের মধ্যে ডুবানো থাকে। এ কারণে ট্রান্সফরমারের দোষ-ত্রুটি দেখা দেয় তবে তা মারাত্মক হতে পারে। এজন্য ট্রান্সফরমারকে সম্পূর্ণ সিস্টেম থেকে যথাশীঘ্র বিচ্ছিন্ন করা ব্যবস্থা থাকতে হবে। এ মারাত্মক দোষ-ত্রুটি থেকে ট্রান্সফরমারকে রক্ষা করার জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্রান্সফরমারের সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রয়োজন ।
ট্রান্সফরমার প্রোটেকশনে ব্যবহৃত প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট এবং প্রোটেকশন সিস্টেমসমূহ :
(ক) গ্যাস রিলে (বুখলজ রিলে)। এটি প্রাথমিক স্তরের ফল্টের জন্য অ্যালার্ম দেয়।
(খ) মারজ প্রাইজ প্রোটেকশন সিস্টেম-এর মাধ্যমে ট্রান্সফরমারকে, ফেজ টু আর্থ এবং ইন্টার টার্ন ফল্ট থেকে রক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।
(গ) অন্যান্য রিলে এবং লাইটিং অ্যারেস্টার দিয়ে উচ্চ ভোল্টেজজনিত কারণে (লাইটনিং সার্জ ও আর্কিং আর্থ ইত্যাদি) ইনসুলেশন অবক্ষয় ত্রুটি থেকে রক্ষা করা হয়।
এছাড়াও কোর ব্যালান্স লিকেজ প্রোটেকশন, সম্মিলিত লিকেজ এবং ওভারলোড প্রোটেকশন সিস্টেম ব্যবহৃত হয়। একটি নির্দিষ্ট পাওয়ার ট্রান্সফরমারের জন্য কোনো ধরনের প্রোটেরকশন পছন্দ করতে হবে তা বিভিন্ন বিষয়, যেমন- ট্রান্সফরমারে আকার (Size) এবং এর গুরুত্ব, কুলিং পদ্ধতি, অন লোড বা অফ লোড, ট্যাপ চেঞ্জার ইত্যাদির উপর নির্ভর করে।
পাওয়ার ট্রান্সকমারের সুরক্ষা ব্যবস্থা নির্বাচনে যে সকল তথ্যাদির প্রয়োজন হয়-
(১) ট্রান্সফরমারের বিস্তারিত বিবরণ-
(ক) কেভিএ (KVA) রেটিং।
(খ) ভোল্টেজ রেশিও।
(গ) ওয়াইন্ডিং-এর সংযোগ প্রণালি।
(ঘ) পারসেন্টেজ রিয়াক্টেন্স বা শতকরা রিয়্যাক্ট্যান্স
(ঙ) নিউট্রাল পয়েন্ট আর্থিং করা আছে কিনা, আর্থিং রেজিস্ট্যান্সের মান
(চ) ইনডোর বা আউটডোরে ব্যবহৃত হবে কি না।
(ছ) কনজারভেটর আছে কিনা।
(২) সিটি এবং রিলে প্যানেল-এর মাঝে ব্যবহৃত কানেক্টিং লিডের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থচ্ছেদ কতটুকু ইত্যাদি।
(৩) পাওয়ার ট্রান্সফরমারের টার্মিনালে ফল্টের পরিমাণ।
(৪) ট্রান্সফরমারের অবস্থানসহ নেটওয়ার্ক ডায়াগ্রাম।
(৫) কোনো প্রোটেকশন পদ্ধতির জন্য বিশেষ প্রয়োজনীয় তথ্যাদি ।
ট্রান্সফরমারের মার্জ-প্রাইস পদ্ধতি(Merz Price Protection System of Transformer Bangla):
ট্রান্সফরমার আরক্ষ (Protection] ব্যবস্থার জন্য সারকুলেটিং কারেন্ট নীতির উপর ভিত্তি করে মার্জ- প্রাইস বা ডিফারেন্সিয়াল পদ্ধতি খুবই উপযোগী। কারণ এটি ফেজ-টু-গ্রাউন্ড এবং ফেজ-টু-ফেজ ত্রুটিতে ফলপ্রসূভাবে কাজ করে। এ ব্যবস্থা প্রয়োগ করার পূর্বে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। কারণ ট্রান্সফরমারের প্রাইমারি এবং সেকেন্ডারি ওয়াইন্ডিং-এর টার্ন সংখ্যা সমান থাকে না। তাছাড়া ট্রান্সফরমারের উভয় দিকের সংযোগ প্রণালিও একই রকম থাকে না। পাওয়ার ট্রান্সফরমারে স্টার-স্টার, স্টার-ডেল্টা, ডেল্টা-স্টার, ডেল্টা-ডেল্টা ইত্যাদি সংযোগ থাকতে পারে। চিত্রে তিন-ফেজ ডেল্টা/স্টার পাওয়ার ট্রান্সফরমারের সংযোগ দেখানো হয়েছে।
চিত্রঃ ট্রান্সফরমারের ডিফারেন্সিয়াল প্রোটেকশন (৩ ফেজ ডেল্টা-স্টার) |
আবার ট্রান্সফরমারের ট্রান্সফরমেশন রেশিও কোনো সময়ই একক থাকে না। কাজেই কারেন্ট ট্রান্সফরমারের (সিটি) সংযোগ এবং টার্ন সংখ্যা এমন হওয়া উচিত যে প্রতি ফেজে স্বাভাবিক অবস্থায় সমান কারেন্ট উৎপন্ন হয় এবং পাইলট ওয়্যারের মধ্য দিয়ে এদের প্রবাহের দিক পরস্পর বিপরীতমুখী হয়। এ অবস্থার জন্য সিটি-দ্বয়ের সেকেন্ডারির প্যাঁচ সংখ্যা বিপরীত হয় এবং ট্রান্সফরমারের স্টার সংযোগের সাথে সিটি-র ডেল্টা এবং ডেল্টার সাথে সিটি’র স্টার সংযোগ হবে।
স্বাভাবিক অবস্থায় সিটি দ্বয়ের সেকেন্ডারিতে প্রবাহিত কারেন্ট সমান ও পরস্পর বিপরীতমুখী থাকে বলে রিলে নীরব থাকে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ কোনো ত্রুটির কারণে সিটি দ্বয়ের সেকেন্ডারির কারেন্ট অসমতা দেখা দিলে রিলে উদ্যমশীল বা সক্রিয় হয়ে সার্কিট ব্রেকারকে ট্রিপ করে সরবরাহ থেকে বিচ্ছিন্ন করবে।
এ পদ্ধতিতে সংযোজিত রিলের অবশ্যই প্রয়োজনীয় টাইম ডিলে বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে। কারণ সুইচিং সার্জ, ট্রানজিয়েন্ট ভোল্টেজ ইত্যাদি কারণে ক্ষণিকের জন্য উৎপাদিত উচ্চ ভোল্টেজে যেন সার্কিট ব্রেকার ট্রিপ না করে সে জন্য টাইম ডিলে ব্যবস্থা থাকতে হবে।
মার্জ-প্রাইস সিস্টেমে ট্রান্সফরমার প্রটেকশনের সময় যে সকল সতর্কতা অবলম্বন করতে হবেঃ
মার্জ-প্রাইস সিস্টেমে যেভাবে জেনারেটরকে প্রোটেকশন দেওয়া হয় ঠিক একইভাবে ট্রান্সফরমার প্রোটেকশন দেওয়া হলেও কিছু কিছু ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। যেমন—
(১) সিটির টার্ন রেশিও বিভিন্ন হয় বা একক থাকে নাঃ সাধারণত ট্রান্সফরমারে ট্রান্সফরমেশন রেশিও কোনো সময়ই একক থাকে না। ফলে ট্রান্সফরমারের প্রাইমারি ও সেকেন্ডারিতে কারেন্টও ভিন্ন মানের হয়। যাতে প্রতি ফেজে স্বাভাবিক অবস্থায় সমান কারেন্ট উৎপন্ন হয় এবং পাইলট ওয়্যারের মধ্যে এদের প্রবাহের দিক বিপরীতমুখী হয়।
(2) ট্রান্সফরমারের সংযোগ-এর বিপরীত সংযোগ CT তে করতে হবেঃ থ্রি-ফেজ পাওয়ার ট্রান্সফরমারের প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি কারেন্টের মধ্যে ফেজ পার্থক্য থাকে। কাজেই এ অবস্থায় সঠিক টার্ন রেশিও (Ratio) যুক্ত সিটি সংযোগ করলেও কিছু পরিমাণ ডিফারেন্সিয়াল কারেন্ট রিলে কয়েলে প্রবাহিত হয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ও রিলেকে অপারেট করাতে পারে। এজন্য সিটি-র সংযোগ ট্রান্সফরমারের সংযোগে বিপরীত হতে হয়।
অর্থাৎ পাওয়ার ট্রান্সফরমারের সংযোগ স্টার/ ডেল্টা হলে সিটি-র সংযোগ ডেল্টা/স্টার হবে। আবার পাওয়ার ট্রান্সফরমারের সংযোগ ডেল্টা/ডেল্টা হলে সিটি-র সংযোগ স্টার/স্টার হয়।
(৩) ব্যবহৃত সিটি-র টার্ন রেশিও পরিবর্তনের জন্য ট্যাপ চেঞ্জিং-এর ব্যবস্থা থাকতে হয়ঃ যেহেতু বিভিন্ন ট্রান্সফরমারে ট্যাপ চেঞ্জিং-এর ব্যবস্থা থাকে এবং ট্যাপ পরিবর্তন করলে সমস্যার সৃষ্টি হয়। সেহেতু স্বাভাবিক অবস্থায় ট্রান্সফরমারের ট্যাপ পরিবর্তন করলেও ডিফারেন্সিয়াল কারেন্ট রিলে অপারেট করে। এজন্য এ সমস্যা সমাধানে সি.টি-তেও অনুরূপ ট্যাপ চেঞ্জিং-এর ব্যবস্থা করতে হয়।
(৪) ব্যবহৃত সিটি গুলো হারমোনিক রেজিস্ট্যান্স এবং হারমোনিক ব্লকিং টাইপ হতে হয়ঃ ট্রান্সফরমার প্রোটেকশনের সময় ম্যাগনেটাইজিং ইন-রাশ কারেন্ট সমস্যার সৃষ্টি করে। স্বাভাবিক লোড কন্ডিশনে ম্যাগনেটাইজিং কারেন্টের পরিমাণ খুব কম থাকে। কিন্তু ট্রান্সফরমার বন্ধ অবস্থা থেকে চালু করলে এ কারেন্ট অল্প সময়ের জন্য খুবই দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এ কারেন্ট রিলেকে অপারেটর করতে পারে, এজন্য সিটি গুলো উক্ত বর্ণিত ধর্মবিশিষ্ট হতে হয়।
আশা করি ট্রান্সফরমার সুরক্ষা ব্যবস্থা ও মার্জ-প্রাইস সিস্টেমে ট্রান্সফরমার প্রটেকশন সম্পর্কে একটি পরিপূর্ণ ধারণা পেয়েছেন।
আরও পড়ুনঃ
- অল্টারনেটরের মার্জ প্রাইস সুরক্ষা কি?
- অল্টারনেটর কি? এটি কিভাবে কাজ করে?
- অল্টানেটরের এক্সাইটেশন পদ্ধতি
- অল্টানেটরের ইএমএফ সমীকরণ